মানব সেবার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত - Dr. KM Alauddin

Latest

Friday, May 10, 2019

মানব সেবার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত



মানব সেবার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত
ডা. কে এম আলাউদ্দীন

জীবন চলার পথে সকল মানুষই চায় সুস্থ থাকতে। প্রাকৃতিক পরিবেশ, সামাজিক অস্থিরতা, সাংসরিক জটিলতা, মানুষের জীবনচক্রে সুপ্ত রকমারী প্রবণতা ইত্যাদি কারণে অধিকাংশ  মানুষ শারীরিক বা মানসিকভাবে সুস্থ্য থাকতে পারছেন না।
      সুস্থতা আসলে মহান আল্লাহর দেয়া এক নেয়ামত। দেহ ও মন নিয়েই মানুষ, দেহ ও মনের সাম্য অবস্থাই স্বাস্থ্য। সকল মানুষই চায় তার জীবনে সুস্থতা বিরাজ করুক, তার জীবন হোক সুন্দর ও স্বচ্ছন্দ।
      জন্ম থেকেই মানুষের জীবন পথে বিভিন্ন জটিলতা স্বাভাবিক সুস্থ্য মানুষ বিভিন্ন প্রকার উত্তেজক, পরিপোষক ও মৌলিক কারণে বিশৃঙ্খলা প্রাপ্ত হয়। জীবন হয়ে পড়ে যন্ত্রণাপূর্ণ, আক্রান্ত হয়ে পড়ে বিভিন্ন প্রকার রুগ্নতা দ্বারা।
      রোগাক্রান্ত মানুষ মুক্তি চায়, মুক্তি চায় জরা-ব্যাধি রোগ-শোক থেকে, চায় সুস্থ স্বাভাবিক জীবন। বলা যায় বর্তমান এ যুগে, প্রায় জন্ম থেকেই সকল মানুষকে রোগ মুক্ত জীবনের খোঁজে ছুটে চলতে হয়- চিকিসা যেন জন্ম থেকেই জীবনের সংগে ছায়ার মতো এগিয়ে চলতে থাকে।
      রুগ্ন মানুষ চিকিসকের দ্বারস্থ হবে এটাই স্বাভাবিক। সমাজে প্রচলিত যে কয়টি চিকিসা পদ্ধতি রয়েছে তার মধ্য থেকে একটি পদ্ধতিকে তিনি বেছে নেবেন। বর্তমান সময়ে যে কয়টি পদ্ধতি চালু রয়েছে তা হলো, এলোপ্যাথি, কবিরাজ, আয়ূর্বেদীয়, সার্জারী, হোমিওপ্যাথি ইত্যাদি।
      আমি এখানে অন্য কোন পদ্ধতির বিষয়ে আলোচনা না করে, হানেমান আবিস্কৃত সর্ব কনিষ্ঠ চিকিসা পদ্ধতি হোমিওপ্যাথি বিষয়ে সাধারণ পাঠকের জন্য সংক্ষিপ্তভাবে কিছু কথা আলোচনা করতে চাই। হানেমান (১৭৫৫-১৮৮৩) তকালিন সময়ের এক জন এম ডি ডিগ্রীধারী চিকিসক ছিলেন, বর্তমানে যে চিকিসা পদ্ধতিকে এ্যালোপ্যাথি বলা হয় তিনি সে পদ্ধতিরই চিকিসক ছিলেন। এমনকি এ এ্যালোপ্যাথি নামটিও হানেমানের দেয়া। হোমিওপ্যাথি (১৭৯০) আবিস্কারের পর তিনি প্রাচীন ঐ চিকিসা পদ্ধতিকে এ্যালোপ্যাথি নামে অবিহিত করেন (অর্গানন-১৮১০)।
      আসলে এক জন সাধারণ রোগী এসব জানতে চায় না বরং তিনি তার রোগ নিয়েই ব্যস্ত। তিনি জানতে চান পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াহীন, জটিলতাহীনভাবে কিসে দ্রুত আরোগ্যলাভ করা যায়। এবং তার একমাত্র চাওয়া হলো, স্বল্পতম সময়ের মধ্যে, সর্বাপেক্ষা নির্ভরযোগ্য ও নির্দোষ উপায়ে তার  নিজের স্বাস্থ্য ফিরে পেতে। তার আশা সর্বোতেভাবে তার রোগ নির্মূল এবং ধ্বংস  হোক, তিনি চান সহজ উপায়ে সাবলীলভাবে আরোগ্য লাভ করতে।
      অন্য অনেক চিকিসা পদ্ধতির চিকিসক রয়েছেন যারা, দেহের অদৃশ্য অভ্যন্তরে কি ভাবে রোগের সৃষ্টি হয় সে বিষয়ে শুধু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেই থাকেন। রোগী ধূকে ধূকে মরণ পথের যাত্রী হলেও সে দিকে তারা ভ্রুক্ষেপ করার সময় পান না। অন্য দিকে রোগের অদ্ভুত বৈচিত্রের ব্যাপারে অসংখ্য ব্যাখ্যা, দুর্বোধ্য ভাষা ও অসার জটিল বিষয় সমূহের অবতারণা করে অনেকে বেশ বাহবা কুড়াতে থাকেন কিন্তু রোগীর তেমন কোন পরিবর্তন হয় না। এমনও দেখা গেছে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে যখন তারা দেহের আভ্যন্তরে রোগের কোন চিহ্ন-খুঁজে পান না অথচ রোগী যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকে তখন রোগীকে ‘মানসিক রোগী বলে আখ্যায়িত করে থাকেন, বর্তমান চিকিসা ব্যবস্থাপনায় এ এক ভাগ্যের নির্মম পরিহাস।
      হোমিওপ্যাথি চিকিসা বিজ্ঞান রুগ্ন মানবজাতির কল্যাণের জন্য এক মহান চিকিসা পদ্ধতি। এ চিকিসা পদ্ধতির চিকিসকগণ রোগের মূল কারণসমূহ অন্বেষণ করে তার রুগ্ন অবস্থার সকল পরিবর্তন অনুধাবন  করে থাকেন। সকল রোগীর দেহ ও মনের সার্বিক অবস্থা সহজবোধ্য  নীতির আলোকে নিরসন করতে চেষ্টা করেন। এবং তিনি রোগীর স্বাস্থ্যের ব্যতিক্রমী অবস্থাকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে দিতে সচেষ্ট থাকেন। যারা এভাবে রোগী সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখেন তাকেই আমরা হোমিওপ্যাথি চিকিসক বলে জানি।
      এখানে সচেতনার সাথে কয়েকটি বিষয় ভেবে দেখা যেতে পারে।
১। বেশ কয়েকদিন যাব একজন রোগীর সমস্ত শারীর ব্যথা করছে। গরম থেকে ঠান্ডা লেগে জ্বর জ্বর ভাব, সদি-কাশি, কাশতে কাশতে বুক ব্যাথা করে। পিপাসা প্রচুর, কোন কাজ করতে ইচ্ছে হচ্ছে না, মাথা ও কপালে খুব ব্যথা, চুপ কর শুয়ে থাকলে  উপশম পায়। অনেক সময় পর পর পানি পান করে, ২/৩ গ্লাস এক সময়ে পান করে।
      অন্য পদ্ধতির এক জন চিকিসক তাকে বুকের এক্স-রে করার পর, মাথা ব্যথা, জœর, কোষ্ঠকাঠিন্য সব মিলিয়ে ৫/৭ প্রকার ঔষধ খেতে দিলেন। ভালো ফল না পেয়ে ২জন চিকিসক পরিবর্তন করেও কমেনি, তবে সামান্য উপশম পেয়েছেন। একজন হোমিওপ্যাথিক চিকিসক ঐ রুগীর সকল অবস্থা ভালোভাবে পর্যালোচনা করে, তাকে শুধু ব্রৃয়োনিয়া এল্ব ২/০ (৫০সহ¯্রতমিক ২শক্তির) ঔষধই প্রেশক্রিপশন করেন। এবং তাতেই তিনি রোগমুক্ত হন।
২। বিয়ে বাড়ীতে দাওযাত খেয়ে রাত্রে অনিদ্রা; খাদ্য বেশ মশলাযুক্ত ছিলো। পর দিন থেকে আমাশয়, শীত শীত লাগছে, বার বার বাহ্যের বেগ হচ্ছে, মলের পরিমান যথেষ্ট নয়। প্রচন্ড বমি, সাথে জ্বর, বার বার বাহ্যের বেগ  কিন্তু বাহ্য হচ্ছে সামান্য, তাতে কিছুটা উপশম। এক জন হোমিওপ্যাথ তাকে শুধু নাক্স ভম ২/০  সেবন করিয়েই রোগীকে আরোগ্য করেন।
৩। রোগীর ডায়ারিয়া, বমি বমি ভাব, ভীষণ ভাবে দূর্বল হয়ে পড়েছেন। কারণ হিসেবে জানা গেলে রোগী ২/১দিন পূর্বে প্রচুর তৈলাক্ত খাদ্য খেয়েছেন সাথে পিঠা ও মিষ্টান্নও ছিল। রোগী ভীষণ দূর্বল, উঠে বসতেও কষ্ট হচ্ছে। জলের মত মল, সাথে বমি। স্যালাইন ও ইনজেকশন দিয়েও তেমন কোন ফল হচ্ছিলো না। এক পর্যায়ে শুধু পালসেটিলা ২/০ সেবনে রোগী সম্পূর্ণ সুস্থতা লাভ করেন।
      বিষয়গুলোর প্রতি সামান্য লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, এক জন রোগীর যতগুলো উপসর্গ দেখা যায় অন্যান্য চিকিসা ব্যবস্থায় ততগুলো ঔষধই প্রয়োগ করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু হোমিওপ্যাথি চিকিসায় দৃশ্যমান প্রকাশিত অনেক উপসর্গ থাকতে পারে, একজন প্রকৃত হোমিওপ্যাথিক চিকিসক সকল অবস্থা বিবেচনা করে, একটিমাত্র ঔষধ দিয়েই আরোগ্য করতে সক্ষম হন।
হতে পারে এক জন রোগীর টিউমার, আঁচিল, নাকের পলিপাস, কোষ্ঠকাঠিন্য, গিটে গিটে ব্যথা, ধ্বজভঙ্গ, ডানদিকে তীব্র মাথা ব্যথা, পক্ষাঘাতিক অবস্থা ইত্যাদি থাকতেই পারে। হানেমানের সঠিক চিকিসায়, চিকিসক রোগীর সকল বিষয় আন্তরিকভাবে জেনে তার জন্য ১০/১২ টি ঔষধ ব্যবস্থা  না করে বরং সুনির্বাচিত একটি ঔষধের মাধ্যমেই রোগীকে আরোগ্য করতে পারেন, এ ধরণের  আরো অনেক সত্য ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। মা-বোনদের ব্রেস্ট টিউমার, জরায়ু নির্গমন মাসিকের সমস্যা, সাদাস্রাব, ওভারিয়ান সিষ্ট ইত্যাদি অনেক রোগী সুনির্বাচিত একটি মাত্র ঔষধে ভালো হয়েছে এমন অনেক উদাহরণ দেয়া যেতে পারে।
      একজন হোমিওপ্যাথিক চিকিসক চায় রোগের গভীরে প্রবেশ করতে। তার এমন কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা অন্য চিকিসা পদ্ধতি থেকে তাকে ভিন্নতা দান করে থাকে। যে কোন সাধারণ রোগাক্রান্ত ব্যক্তির তা জানা থাকলে সঠিক চিকিসা পদ্ধতি খুঁজে পেতে তাকে সাহায্য করবে। একজন হোমিওপ্যাথিক চিকিসক রোগীর সকল কষ্ট নিজে অত্যন্ত যত্ন সহকারে খুঁজে পেতে চেষ্টা করবেন। আপনার রুগ্ন অবস্থার মৌলিক ও বাহ্যিক কারণসমূহ তিনি জেনে, বুঝতে সচেষ্ট হবেন যে, আপনার প্রকাশ্য রোগের মধ্যে কি আরোগ্য  করতে হবে। হঠা করে এমন সিদ্ধান্ত তিনি নেবেন না যাতে অকারণ ক্ষতির আশংকা বা আর্থিক অপচয়ের সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে।
প্রসংগতঃ বলা যায়, কোন যন্ত্র বা যান্ত্রিক পরীক্ষা নিরীক্ষা মানুষের কষ্ট বা যন্ত্রণা সমুহ উপলব্ধির ক্ষমতা রাখে না। রোগের পরীক্ষা নিরীক্ষার প্রয়োজন নেই এখানে  এ কথা বলা হচ্ছে না। প্রথমে চিকিসক রোগীর সর্বদিক ভালোভাবে শুনে, কষ্টের বর্ণনাসমূহ উপলদ্ধি করে, সবচেয়ে প্রয়োজনীয় দিকটি বিবেচনা করবেন। চিকিসার প্রয়োজনে তিনি অবশ্যই পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা করবেন। এবং সকল দিক বিবেচনা করে রোগের জন্য রোগীকে ব্যবস্থাপত্র প্রদান করবেন এটাই স্বাভাবিক। রুগী এল তার ২/১ টি কথা শুনে ৫/৭ মিনিটেই পরীক্ষা নিরীক্ষা জন্য পাঠিয়ে দেয়া হলো, তেমন কোন কথা না শুনেই  একসাথে ১০/১২টি ঔষধ লিখে রোগীকে বিদায় করবেন এটা স্বাভাবিক বলে মনে হয় না। রোগী অসহায়, তাদের একমাত্র চাওয়া আল্লাহ্র রহমত ও চিকিসকবৃন্দের মানবিক আচরণ।
 হানেমানের মতে, হোমিও ঔষধ রোগীর রোগশক্তিকে পরাজিত করে তার স্বাস্থ্যের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে দিতে সক্ষম। এ কারণে হোমিও ঔষধ শক্তিকৃত অবস্থায় প্রয়োগ করা হয়। হোমিও ঔষধের ক্ষুদ্রতম মাত্রাই রোগী আরোগ্যের জন্য যথেষ্ট। এমনকি শক্তিকৃত ঔষধ ৪ আউন্স পানিতে মিশিয়ে সেখান থেকে ২/১ চামচ ঔষধ সেবন করলে রোগী আরো দ্রুত আরোগ্যলাভ করে। বিভিন্ন প্রকার রং-বেরঙের ঔষধ, ট্যাবলেট, ক্যাপসুল বা যে কোন ধরণের ইনজেকশন, এসব হোমিও ঔষধ নয়। বরং এ ধরণের ঔষধ দ্বারা চিকিসার নামই অপ-হোমিওপ্যাথি। জানা যায়, হোমিওপ্যাথিক চিকিসক রোগীর সকল বর্ণনা ধৈর্য্যসহকারে শুনে, উপলব্ধি করে ব্যবস্থাপত্র প্রদান করে থাকেন। এবং রোগীর অপ্রয়োজনীয় আর্থিক ক্ষতি যাতে না হয়, সে মানবিক দিকটি সঠিক হোমিওপ্যাথ চিকিসকগণ অবশ্যই বিবেচনা করে থাকেন।
অবশেষে বলতে চাই, আপনার পাশেই রয়েছে মানব কল্যাণে আবিস্কৃত হোমিওপ্যাথিক চিকিসা পদ্ধতি, মানব সেবার অনন্য দৃষ্টান্ত; আশা করি এ প্রাকৃতিক চিকিসা পদ্ধতি নিশ্চয়ই আপনার রোগ মুক্তির কারণ হবে, ইনশা-আল্লাহ্।
=সমাপ্ত=

লেখক পরিচিতি ঃ
ডা. কে এম আলাউদ্দীন, কেন্দ্রীয়  সহ-সভাপতি ও
বরিশাল জেলা শাখার সভাপতি, বাহোপ। ০১৭১১-১০৮৩২৫

No comments:

Post a Comment