একজন হোমিও চিকিৎসকের সন্ধানে
-ডাঃ কে এম আলাউদ্দীন
(১)
কে না চায় জীবনটা সুন্দর হোক, স্বার্থক হোক, সর্বদিক দিয়ে জীবনে সফলতা আসুক। কিন্তু সবকিছুর মূলেই রয়েছে স্বাস্থ্য। স্বাস্থ্য নেই, সুখ নেই, শান্তি নেই- জীবনের সকল আশাই যেন ক্ষীনায়মান প্রদীপের ন্যায় অস্তিত্বহীনতার দিকে ধাপিত হতে থাকে। সুস্থতা মহান আল্লাহর অসীম করুনার দান। স্বাস্থ্যের সামান্যতম বিশৃঙ্খলার নিদর্শন শরীরে পরিস্ফুট হলেই বা বাহ্যিকভাবে পরিলক্ষিত হলে তাও মহান স্রোষ্টার অসীম করুণা, কারণ তা-ই আরোগ্যের পথ নির্দেশিকা। হানেমানের ভাষায় তাই বলা যায়, মানব দেহের অভ্যন্তরে এমন কোন বিকৃতি বা রোগজ অদৃশ্য পরিবর্তন থাকতে পারে না যা আরোগ সাধ্য অথচ রোগসূচক চিহ্ন ও লক্ষণের দ্বারা যথার্থ পর্যবেক্ষণশীল চিকিৎসকের নিকট আত্ম প্রকাশ করে না । সর্বজ্ঞাতা মানবজীবন রক্ষাকর্তার (all-wise preserver)অসীম করুণার (infinite goodness) নিদর্শনই হচ্ছে এই বিধান।আআ অর্গনন,প্যারা- ১৪
তবু রোগ-শোক-জড়া-ব্যধি বার্ধক্য নিয়েই জীবন। জীবন চলার পথে সুস্থ্যতার ব্যতিক্রম দেখা দেবে এটা স্বাভাবিক। প্রকৃতির মাঝে বেঁচে থাকতে হলে প্রকৃতির সাথে সৃঙ্খল সহ-অবস্থান একান্ত প্রয়োজন।ক কিন্তু আমাদের চলার পথ আমাদেরই ইচ্ছাধীন। এখানে প্রকৃতির ইচ্ছার সাথে আমাদের ইচ্ছার টানাপোড়ন বা দ্বন্দ অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়। আর যেখানে দ্বন্দ সেখানে অনিবার্যভাবে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবেই। স্বাস্থ্যের বিশৃঙ্খলার মূল কারণ যেন এখানেই নিহিত রয়েছে।
সাঈদ সাহেবের পত্র পাঠের পর মনের মধ্যে এ সব কথাই আলোড়িত হচ্ছিলো। তার পাঠানো সে পত্রের অংশ বিশেষ হুবহু তুলে দিলাম...........
‘‘-আমি আমার রুগ্নতার বিষয়ে বেশ উদ্বিঘ্ন। দীর্ঘদিনের অসুস্থতা আমার জীবনকে বিষিয়ে তুলেছে, শান্তি নেই, সুখ নেই চারিদিকে যেন যন্ত্রনাময় জীবন। এক চিকিৎসকের নিকট থেকে অন্য চিকিৎসকের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে ঘুরতে দিশেহারা পথ খুঁজে পাই না। যন্ত্রনাকাতর এ জীবন আজ আমার কাছে দূর্বিসহ হয়ে উঠেছে তবু আমি বাঁচতে চাই, সুখ চাই, হারানো স্বাস্থ্য ফিরে পেতে চাই। ছাত্র জীবন থেকেই হীন স্বাস্থ্য, দূর্বল দেহ, স্বপ্নদোষের প্রবণতায় আক্রান্ত, যৌন-বিকৃতির খেলায় অভ্যস্থ; চিন্তার বৈকল্য, স্বরণ-শক্তিহীনতাসহ আরো অনেক ধরণের সমস্যায় জর্জরীত হয়ে পরি।
ঝাড়-ফুঁক দিয়ে চিকিৎসা জীবন শুরু করি, কবিরাজি, হারবাল, এলোপ্যাথি, হোমিওসহ সকল ধরণের চিকিৎসার স্বাদই গ্রহণ করেছি। অর্থের সমস্যা না থাকায় চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণে কোনো প্রকার ত্রুটি করিনি। টি-ভির কল্যাণে চোখ-ঝলসানো চমকপ্রদ আকর্শনীয় কথামালায় মুগ্ধ হয়ে বিভিন্ন চিকিৎসকের কাছেও বহুবার গিয়েছি। ঔষধ নয় খাদ্যেই রোগ আরোগ্য- এ ধরণের কথা শুনে লোভ সামলাতে না পেরে তাদের কাছেও যেতে দ্বিধা করিনি।
কোনো চিকিৎসায় কখনো উপকার পাইনি তা বলা ঠিক হবে না। কখনো কখনো স্বাস্থ্যেরও উন্নতি দেখেছি কিন্তু ধীরে ধীরে তা আবার পূর্বাবস্থায় ফিরে গেছে। চিকিৎসায় যে শান্তি-স্বস্থি পাওয়া যায় তা কখনো পেয়েছি বলে মনে হয় না।”
হাঁ, হোমিও চিকিৎসায় কি অবস্থা হয়েছিল তার কিছু কথা আপনাকে জানাতে চাই। বিষয়টি বড়ই চমৎকার বলে মনে হয়েছে। যার কাছে গিয়েছি তিনিই তার চিকিৎসা জীবনের অনেক অনেক সফলতার কাহিনী শুনিয়ে তার চিকিৎসা কাজ শুরু করেছেন। তারা যে চিকিৎসায় কোন উপশম দিতে পারেননি তা নয়। তবে সম্পূর্ণভাবে সফল যে হতে পারেননি তার প্রমাণ তো আমি নিজেই। প্রথমে খুব বড় একটি হোমিও ফার্মেসী দেখে সেখানে যাই। বেশ সাজানো গোছানো, এলোপ্যাথি ফার্মেসীর চেয়েও অনেক বেশী আধুনিক আসবাব পত্রে ঝক-মকে সাজে সজ্জিত, ঔষধও প্রচুর। বড় বড় অনেক পেটেন্ট-ফাইল, বেশ সুন্দর, উজ্জ্বল আলোয় উদ্ভাসিত। ২/৩ জন সেল্সম্যান ঔষধ বিক্রয়, তৈরী ও প্রদানের কাজে ব্যস্ত; রোগীর লাইন মোটামুটি মন্দ নয়।
চিকিৎসকের চেম্বার- ছোট একটি রুম, বেশ পরিপাটি, মার্জিত; চিকিৎসকের বয়স ৩৫-৪০ বৎসর, ভদ্রলোক আমার বিশেষ বিশেষ কথাগুলো শুনে, নোট খাতায় লিখে, প্রেসক্রিপশন করলেন। ঔষধ লেখা হল ৪/৫ প্রকার; তরল ঔষধ, টেবলেট(বায়োকেমি) ও ২/৩টি ফাইল মিলিয়ে অনেক ঔষধ দিলেন; অর্থের বিষয় আমি ভাবিনি; তিনি কোন ফি নেন না, ঔষধ মূল্যই অনেক। প্রথম ১৯ দিনের ঔষধের জন্যই দিতে হল ৮০০০/-টাকা। পরপর ২/৩বার ঔষধ এনেছি। প্রথমবার কিছুটা উপশম পেলেও, পরে পূর্বাবস্থার চেয়েও খারাপের দিকে ধাপিত হচ্ছিলাম, নিরাশ হয়ে ঔষধ সেবন বন্ধ করি।”
এ পর্যন্ত পাঠ করার পর ভাবতে লাগলাম- রোগী কিভাবে একজন আদর্শ হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকের সন্ধান পাবে, তা তাদের অবশ্যই জানার অধিকার রয়েছে। এ বিষয়টি জানাবার দায়িত্ব হানেমানের আদর্শে অনুপ্রাণিত সকল চিকিৎসক বৃন্দের। একজন রোগীকে অন্য-প্যাথির সঠিক চিকিৎসক খুঁজে পেতে খুববেশী কষ্ট করতে হয় না। একজন সঠিক মানের হোমিও চিকিৎসকের পরিচয় একজন রোগীর কাছে যেন সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে সে বিষয়টি প্রচার ও প্রকাশে আমাদের হানেমান-অনুসারি চিকিৎসক সমাজকেই এগিয়ে আসতে হবে। এখানে মৌলিক কয়েকটি দিক মাত্র উল্লেখ করা হল।
একজন আদর্শ চিকিৎসক চেনার উপায়-
১। পীড়িত মানব যখন সাহায্যের আশায় অসহায় ভাবের ধুকতে থাকে, তখন একজন আদর্শ চিকিৎসক অবশ্যই, পান্ডিত্যপূর্ণ-কল্পনা ও অনুমান ভিক্তিক চিকিৎসা পদ্ধতি পরিত্যাগ করে কেবলমাত্র গালগল্প দ্বারা প্রতারণা করার পরিবর্তে, পীড়িত মানুষের রোগমুক্তির সত্যিকার পথে নিজেকে উৎসর্গ করবেন।
আসলে মানুষটি সুস্থ ছিল, বাহ্যিক,: পারিপার্শ্বিক বা আভ্যন্তরিণ যে কোনো কারণেই হোক না কেন অসুস্থ হয়েছে, স্বাস্থ্য তার স্বাভাবিকত্ব হারিয়েছে- বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। একজন চিকিৎসকের কাজ হবে সকল বিশৃঙ্খলা দূর করে রুগ্ন-পীড়িত-অসহায় মানুষটির স্বাস্থ্যের স্বাভাবিকত্ব ফিরিয়ে দেয়া। এ কারণেই হানেমান সকল চিকিৎসকবৃন্দকে তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে অ্ত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে জানিয়ে দিয়েছেন, ‘‘ রোগীকে পুনরায় স্বাস্থ্য ফিরিয়ে আনাই হচ্ছে চিকিৎসকের উদ্দেশ্য এবং একমাত্র ব্রত, যাকে বলা হয় আরোগ্য সাধন করা। -(The Physician's high and only mission is to restore the sick to health, to cure as it is termed. Org.apho- 1)”
২। চিকিৎসকের প্রধান কাজই হল, দ্রুত, বিনাকষ্টে ও অপরিবর্তনীয় ভাবে রোগীকে স্বাস্থ্যে ফিরিয়ে আনা; অন্যভাবে বলা যায়, রোগী আরোগ্যে অহেতুক কালক্ষেপণ করা যাবে না, আরোগ্যের আশায় রোগীকে ইচ্ছাকৃত এমন কোনো কষ্ট দেয়া যাবে না, যাতে সাময়িক উপশমের পর রোগীর জীবন অজ্ঞাতে, ধীর গতিতে ধ্বংসের পথে ধাবিত হতে থাকে। চিকিৎসকের উচিৎ- যে অবস্থা থেকে স্বাস্থ্য বিকৃত হল সে অবস্থায় রোগীকে তা ফিরিয়ে দেয়ার সর্বপ্রকার প্রচেস্টা গ্রহণ করা। অবশ্য এ জন্য দূর্বোদ্ধ কোনো নীতি গ্রহণ করা যাবেনা, নীতি হবে সহজ বোধ্য সর্বাপেক্ষা নির্ভরযোগ্য। তিনি যেসব উপায় গ্রহণ করবেন তা হবে সম্পূর্ণ নির্দোষ এবং অবশ্যই তাকে স্বল্প সময়ের মধ্যে, সামগ্রীক ভাবে ব্যাধিকে নির্মূল ও বিনাশ করতে হবে।
দ্রুত রোগ আরোগ্যের বিষয়টি যেন আজ হোমিও চিকিৎসা জগৎ থেকে বিদায় নিয়েছে। প্রায় সকল চিকিৎসকগণ নিজেদেরই অজান্তে, রোগীদের মধ্যে ভুল ধারণা সৃষ্টি করে দিয়েছেন যে, হোমিওতে রোগ আস্তে আস্তে কমবে। কি আশ্চর্য! দীর্ঘ দিন ঔষধ সেবনেও রোগ আরোগ্যের সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছেনা তার পরও চিকিৎসক বলছেন, ঔষধ সেবন করতে থাকুন এক সময় রোগ কমে যাবে! এ কেমন কথা, অনেক দিন পর রোগ কি হঠাৎ করে অলৌকিক কোনো জাদুর স্পর্শে পালিয়ে যাবে! যে কোন একদিনে-ই রোগী হঠাৎ করে আরোগ্যলাভ করে ধেই ধেই করে নাচতে থাকবে! এটা যুক্তি-পূর্ণ নির্ভর-যোগ্য কথা হতে পারে না। এ কোনো সহজবোধ্য কথা নয় - রোগ ধীরে ধীরে কমতেই পারে, তারও এক প্রকার স্বাভাবিকত্ব থাকে, রোগ নির্মূলের দিকে স্বাভাবিক ভাবেই অগ্রসর হতে পারে। আরোগ্য চাপিয়ে দেয়ার বিষয় নয়, সহজ গতিতে লক্ষ্যের পথে ধাবমান একটি প্রক্রিয়া মাত্র।
হানেমানের ভাষায়, The highest ideal of cure is rapid, gentle and permanent restoration of the health, or removal and annihilation of the disease in its whole extent, in the shortest, most reliable and most harmless way, on easily comprehensive principles. –Org.apho-2
৩। প্রত্যেক রোগী তার বহি:প্রকাশিত লক্ষণসমূহ নিয়ে একজন চিকিৎসকে নিকট আসেন। অবশ্যই চিকিৎসক তার প্রদর্শিত প্রকাশ্য লক্ষণ গুলো সম্পর্কে জ্ঞান রাখবেন এবং রোগী ক্ষেত্রে কি আরোগ্য করতে হবে (what is to be cured in disease) তা তিনি সুষ্ঠুভাবে বুঝবেন। যদি শুধু বলা হয় তিনি রোগ সর্ম্পকে জ্ঞান রাখবেন, তা হলে কথাটি সঠিকভাবে বলা হল না। বরং প্রত্যেক রোগীর ক্ষেত্রে যা আরোগ্য করতে হবে তা তিনি বিজ্ঞ ডুবুরীর ন্যায় অন্বেষণ করে নির্মল আরোগ্যের মণি-মুক্তা খুঁজে বের করবেন।
৪। একজন চিকিৎসকের সঠিক তত্ত্ব জ্ঞানই রোগ আরোগ্যের হাতিয়ার হতে পারে না। আরোগ্যের প্রধান হাতিয়ার হল এমন ঔষধ যার মধ্যে ঘুমন্ত সুপ্ত লক্ষণরাজি সৃষ্টির প্রবণতা বিরাজমান, যা আরোগ্যকর শক্তির আধার- যার শক্তি আছে, সীমা আছে, বিশেষ বিশেষ যোগ্যতা আছে; এমনকি রোগ দূরীকরণে যা তার আভ্যন্তরিণ শক্তির প্রভাব বিস্তার করে। একজন চিকিৎসককে তা ভাবতে হবে, বুঝতে হবে; ঐ চিকিৎসককে তা বাস্তবে প্রয়োগ করে ঔষধের শক্তি (knowledge of medicinal power) সর্ম্পকে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হবে । ঔষধ বিষয়ক জ্ঞান অর্জন করতে হবে শুধু এ কথা বল্লেই একজন চিকিৎসক ঔষধের পূর্ণ জ্ঞানের অধিকারী হতে পারেন ((৯ক্কমনা। তাকে জানতে হবে, অনুধাবন করতে হবে ঔষধের মধ্যে আরোগ্যকারী শক্তি কি বা কোথায় লুকিয়ে রয়েছে (what is curative in medicines)|
৫। একজন রোগীর মধ্যে রোগ বলে যা যা জানা যায় তার সবই জানতে হবে। কি ভাবে জানা যায় , কেমন করে জানা যায় তা অবশ্য ভিন্ন বিষয়। মূল কথা হল রোগীর সকল দু:খ-কষ্ট, সকল জ্বালা-যন্ত্রণা, মানসিক ও শারীরিক সকল বিশৃঙ্খল অবস্থা সমূহ এক কথায় রোগীর সমগ্রীক অবস্থাই (totality of the symtoms) জানতে হবে।
ঔষধের মধ্যেও ভিন্নভাবে, কোন এক যন্ত্রনা কাতর রোগী তার সামগ্রীক অবস্থা নিয়ে নিরবে, উপযুক্তভাবে ব্যবহৃত হবার জন্য অপেক্ষমান। একজন বিজ্ঞ চিকিৎসকই পারেন তার মধ্যে সুপ্ত-অবিকশিত আরোগ্যকারী শক্তিকে সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে। সুপ্ত শক্তি নিয়ে অপেক্ষমান বহু ঔষধের মধ্য হতে রোগীর জন্য সুনির্বাচিত একটি ঔষধ (suitability of medicine) খুঁজে পাওয়া এক মহা সাধনার বিষয়- যা একজন বিজ্ঞ চিকিৎসকেরই আয়ত্বাধীন। চিকিৎসক ধ্যানে-জ্ঞানে-কল্পনায় রোগীর জন্য একটিমাত্র ঔষধই খুঁজে বের করবেন; একমাত্র তাকেই বুঝতে হবে, রোগীর জন্য নির্বাচিত ঔষধটিই সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত কি না। রোগী আরোগ্যের জন্য ঔষধ হবে শুধুমাত্র একটি- একাধিক নয় বা একটির সাথে ভিন্ন ধর্মী কোন ফাইল বা পেটেন্ট ইত্যাকার ঔষধের মহা-সমষ্টি নয়, তেমন কিছু করা মানে স্ব-জ্ঞানে রোগীর পকেট ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র ছাড়া অন্য আর কি হতে পারে।
*সমাপ্ত *
Alhamdulillaha...
ReplyDeleteahmamdulillaha
ReplyDeleteমাশাল্লাহ
ReplyDelete